সুর "বন্ধনের" সহযাত্রী ও বিশ্বাসের পূর্ণতা: চিত্রা রোজারিও, নিউইর্য়ক
চিত্রা রোজারিও, প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:
গত ২৭শে জানুয়ারি, ২০২৫ — গান ও ভালোবাসার সুর "বন্ধনের" সহযাত্রীর সাথে ঘুরে এলাম কলকাতা ও গোয়া; যার মূল কেন্দ্রে ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয়, ভালোবাসার মানুষ, আমাদের গর্বের দাদা — একজন সহজ-সরল, সাহসী, প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক, আবেগী ও অকুতোভয় গানের জগতের প্রিয়মুখ — মহিতোষ তাপস তালুকদার।
আমি যখন জানতে পারলাম দাদা এবার গোয়ায় যাচ্ছেন, তখনই আমার মনে হলো এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে দাদাকে ফোন করতেই তিনি আমাকে টিকিট কাটার ইটিনারি পাঠিয়ে দিলেন। অনেকদিন ধরেই গোয়া যাওয়ার একটা আধ্যাত্মিক ইচ্ছা ছিল — সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ারের অমর দেহ দর্শনের! ছোটবেলা থেকে এই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সুযোগ বা আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই সুযোগ পেয়ে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রেখে, সাধু জেভিয়ারের মধ্যস্থতায় তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
১৫৫২ সালের ৩রা ডিসেম্বর, চীনের সাংচিয়ান দ্বীপে মিশনারি কাজের সময় সাধু জেভিয়ার মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে নাবিকদের বলে যান যেন তাঁর দেহ গোয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর মরদেহ আজও গোয়ার ‘বোম জিসাস’ গির্জায়, রুপার কফিনে সংরক্ষিত — কোনো কেমিক্যাল ছাড়াই! ধর্ম ক্লাসে জেনেছিলাম, তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় বলেছিলেন, “সমস্ত জগৎ লাভ করে যদি নিজের আত্মাকে হারাই, তাহলে লাভ কী?” সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি সংসার ছেড়ে যীশু খ্রিষ্টের বাণী প্রচারে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
আমার সঙ্গে কলকাতা ও গোয়া যাওয়ার পরিকল্পনায় ছিলেন জ্যানেট দি। তবে তিনি তখন বাংলাদেশে ছিলেন এবং শুরুতে যাওয়া নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। পরে হঠাৎ একদিন মেসেজে জানালেন, তিনিও যাবেন! তখন আমার আনন্দ আর ধরে না — যদিও তখনও আমাদের ভিসা নেই, হাতে মাত্র তিন দিন! কিন্তু ঈশ্বর যেন অলৌকিকভাবে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সাশ্রয়ী মূল্যে আরব আমিরাত হয়ে প্লেন টিকিট পেলাম — এমনকি তিন মাস আগে কাটলেও এত ভালো ডিল পাওয়া যেত না! বোস্টনের অমিতাভদা আমাদের জন্য গোয়ার টিকিটসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেন। আমি শুধু প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন সুস্থভাবে যাত্রা শেষ করতে পারি।
৩০শে জানুয়ারি কলকাতায় পৌঁছে এক দিদি-ভাইয়ের বাড়িতে আতিথেয়তায় থাকলাম। এরপর সুরজাহান আয়োজিত বিশ্ব সংগীতের আসরে (World Peace Music Festival) সুরবন্দনের পরিবেশনায় অংশ নিলাম — গল্ফ গ্রিন সেন্ট্রাল পার্কে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে প্রায় ৩০০ জন শিল্পী অংশ নেন। নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, আইসল্যান্ড, রাজস্থান, বাংলাদেশের বাউলসহ নানা দেশের শিল্পীদের পরিবেশনায় মঞ্চ হয়ে ওঠে এক বৈশ্বিক মিলনমেলা। সলিল চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসর্গ করা সেই আয়োজনে আমরাও সলিলদাকে প্রণাম জানিয়ে গান গাই।
মহিতোষ তাপস তালুকদার দাদার কথা বললে বলতেই হয় — কিছু মানুষ জন্মান যুগে যুগে, যাঁদের উপস্থিতিই আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। তিনি নিজে যেমন আনন্দে থাকেন, তেমনই অন্যকেও আনন্দে রাখতে ভালোবাসেন। এমনকি যাঁরা ভালো গান গাইতে না পারেন, তাঁরাও তাঁর সুরের ছোঁয়ায় মঞ্চে প্রাণ খুলে গেয়ে ওঠেন। দাদার অসাধারণ সংগীত পরিচালনা ও উদ্দীপনায় আমিও আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়েছিলাম।
এরপর স্বপ্নের গোয়ায় গেলাম — সেখানে ৫ দিন ছিলাম। সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ারের দেহ দর্শনসহ অনেক ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখলাম। “কালা একাডেমিতে” সুজাহানের আয়োজনে অংশগ্রহণ যেন ঈশ্বরের পক্ষ থেকে বিশেষ আশীর্বাদ। কলকাতা ফিরে দাদার ‘আলোর দিশারী’ সংগঠনের মাধ্যমে পথশিশুদের গান শেখানো, ‘বাংলা নাটক ডট কম’-এর আয়োজনে বর্ধমানের বন নব গ্রামে বাউল আশ্রমে মোমবাতি হাতে গান গাওয়া, শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়ি শালবনে পরিবেশনা, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গাওয়া — সবকিছু যেন এক স্বপ্নের মতো। আর এসবই সম্ভব হয়েছে তাপস দাদার জন্যই।
সবশেষে ১৭ই ফেব্রুয়ারি, বান্ডেল চার্চ, বেলুড় মঠ, মাদার তেরেসার আশ্রমে প্রার্থনা শেষে সুস্থ শরীরে, ভরপুর আনন্দে ঘরে ফিরে এলাম। মনে হচ্ছিল, এটা যেন ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া বোনাস আশীর্বাদ!
আসলে গানই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে — নির্মল আনন্দ দিয়ে। তাপস দাদার কথা বারবার মনে পড়ে
“মানবিকতার জয় হোক, মানবতার জয় হোক, জীবন হোক সুন্দর ও আনন্দময়।”
তাঁর সেই কথার রেশ ধরেই বলি — আসুন, আমরা ভালোবাসার সৌন্দর্যের চর্চা করি, অন্যকে ভালো রেখে নিজেরাও আনন্দে বেঁচে থাকি।
চিত্রা রোজারিও, নিউ ইয়র্ক